নোমান
পাটোয়ারী।। ১০ জানুয়ারি ২০২০: সদ্য গত ২০১৯ সাল ছিল
স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের অর্জনের বছর। গতকাল সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে বিদায় নিল ঘটনাবহুল
২০১৯ সাল। ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে হারিয়ে গেলো আরেকটি সুখ দু:খের বছর। এরিমধ্যে, স্বাস্থ্যব্যবস্থায়
যোগ হয়েছে নতুন নতুন সুবিধাদি। প্রাপ্তির পাশাপাশি এ খাতে রয়েছে অপ্রাপ্তিও।
বিদায়ের এই ক্রান্তি লগ্নে ফিরে দেখা যাক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে
প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, সাফল্য ও অর্জনের চিত্র গেল বছর কেমন ছিল?
বাংলাদেশে
মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭২.৩ বছর:
বিগত বছরের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কিছুটা বেড়ে
৭২ দশমিক ৩ হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষের আয়ু ৭০ দশমিক ৮ বছর আর নারীর ৭৩ দশমিক ৮ বছর। ফলে
পুরুষের থেকে নারীরা গড়ে তিন বছর বেশি বাঁচে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু
৭২ বছর ছিল। এছাড়া ২০১৬ সালে ৭১.৬, ২০১৫ সালে ৭০.৯, ২০১৪ সালে গড় আয়ু ছিল ৭০ দশমিক
৭ বছর।
২০১৩ সালে গড়
আয়ু ছিলো ৭০ দশমিক ৪ বছর। ২০০৮ সালে গড় আয়ু ছিলো ৬৬ দশমিক ৮ বছর।
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা পেলেন ‘ভ্যাকসিন হিরো পুরস্কার:
শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশে টিকাদান
কর্মসূচির সাফল্যের জন্য গেল বছর ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত হলেন প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে এ পুরস্কার
দেয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।
ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত সুইজারল্যান্ডভিত্তিক
সংস্থা জিএভিআই টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে সারাবিশ্বে কোটি কোটি শিশুর জীবন রক্ষায়
ভূমিকা রাখছে।
মাতৃ
ও শিশুমৃত্যু হার কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে:
সরকার মাতৃ ও শিশু মৃত্যুরোধে সকল সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি
করায় দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু উভয়ই কমেছে। ২০১৭ সালে গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি
লাখে ১৭৬ জন থাকলেও বর্তমানে তা ১৭২ জন। এছাড়া ২০১৫ সালে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে
মৃত্যুহার ২০ জন থাকলেও বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ১৮ দশমিক ৪ ভাগে দাঁড়িয়েছে।
শূন্য থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে
আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যকে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) স্বীকৃতি
দিয়েছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ ‘বার্ষিক
গ্লোবাল চাইল্ড হুড রিপোর্ট ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ,
ভুটান, ভারত ও নেপালে গত দুই দশকে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে।
বাজেটে
স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা:
স্বাস্থ্যখাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে
বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) এই খাতে বরাদ্দ
ছিল ২৩ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এর অর্থ এর আগের বছরের চেয়ে ৬ হাজার ৮১ কোটি টাকা বেশি।
এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বরাদ্দ জিডিপির ১.০২ শতাংশ এবং মোট বাজেট বরাদ্দের
৫.৬৩ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিশ্বমানের
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইউনিট স্থাপন:
২০১৯-২০ অর্থবছরে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশ্বমানের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট
ইউনিট এবং সাধারণ রোগীদের সেবার পরিধি বাড়াতে ওপিডি ভবন-১ ও ওপিডি ভবন-২ এর ঊর্ধ্বমুখী
সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছে।
৮টি
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসে ইনমাস স্থাপন:
২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ৮টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
ক্যাম্পাসে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সস (ইনমাস) স্থাপন
ও বিদ্যমান ৬টি ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইনস্টিটিউট অব ইলেক্ট্রনিক্সের
গবেষণাগারে সুবিধা উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন এবং রেডিওথেরাপি, ডায়াগনস্টিক রেডিওলজি, নিউট্রন
ক্রমাঙ্কন ও মান নিয়ন্ত্রণে স্ট্যান্ডার্ড গবেষণাগার স্থাপন করার উদ্যোগ হাতে নেয়া
হয়েছে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক
এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশের আশাব্যঞ্জক সাফল্য:
স্বাস্থ্যবিষয়ক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের
বেশ অগ্রগতি হয়েছে। গত বছরেও স্বাস্থ্য সেক্টরের উন্নয়নের চিত্র ছিল আশাব্যঞ্জক। দেশের
সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক। এমন মজবুত অবকাঠামোর ওপর
দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার মাত্রার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশের
স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে জনবল বৃদ্ধি,
অবকাঠামো উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিক
চালু, স্বাস্থ্যখাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম ইত্যাদি উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করে
সরকার। দেশের ৯৯ ভাগ উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে রয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার
ব্যবস্থা।
জেলা-উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ৪৫০০ নতুন ডাক্তার
নিয়োগ:
জেলা-উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডাক্তার সংকট নিরসনে
নতুন করে সাড়ে ৪ হাজার নতুন ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও দুই হাজার ডাক্তারকে
সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার
পাশাপাশি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন।
স্বাস্থ্য
খাতে ব্যর্থতা:
স্বাস্থ্য
সুরক্ষা ব্যয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ:
বাংলাদেশে টাকার অংকে বাড়লেও জিডিপির তুলনায় বরং কমছে
স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়। দেশের সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ৬৪ ভাগ নিজেদেরই বহন
করতে হচ্ছে। অগ্রাধিকার নির্ধারণে দুর্বলতা বাড়তে থাকায় এখাতে সার্বিক ব্যয়ও বাড়ছে
যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনকি স্বাস্থ্য খরচ জোগাতে হিমশিম
খাওয়া দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্র হয়ে পড়ছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ মোট জাতীয়
উত্পাদনের (জিডিপি) এক শতাংশেরও কম ব্যয় করছে স্বাস্থ্য খাতে। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার
অন্য দেশগুলো আরো বেশি ব্যয় করছে। অর্থাত্ সরকারিভাবে স্বাস্থ্যখাতে অধিক গুরুত্ব দিয়ে
ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না। এতে দেখানো হয়, বাংলাদেশ মাথাপিছু ৩২ ডলার ব্যয় করেছে
স্বাস্থ্য খাতে। যেখানে ভারত ৫৯ ডলার, নেপাল ৪৫ ডলার, পাকিস্তান ৩৮ ডলার এবং শ্রীলঙ্কা
ব্যয় করেছে ১৫১ ডলার। শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, উন্নয়নশীল বিশ্বের চেয়ে বাংলাদেশ সবচেয়ে
কম ব্যয় করছে স্বাস্থ্য খাতে। গড়ে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ১৩০ ডলার ব্যয় হয় স্বাস্থ্য
খাতে।
বাংলাদেশে
বছরে ২ লাখ ব্যাগ রক্তের ঘাটতি:
দেশে প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। এর
মধ্যে ৭ লাখ ব্যাগ পাওয়া যায়। ঘাটতি থেকে যায় আরো প্রায় ২ লাখ ব্যাগ রক্তের। সবাই রক্তদানে
উদ্বুদ্ধ হলে দেশে রক্তের সংকট নিরসন সম্ভব বলে জানান বিশেষজ্ঞগণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, উন্নত বিশ্বে প্রতি
হাজারে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয় ৪৫০ জন, আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাত্র ৩ জন। তারপরও রক্তদাতার
সংখ্যা বাড়লেও পর্যাপ্ত নয়।
শুষ্ক
মৌসুমে ঢাকা শহরের ধুলিদূষণ হয় সহনীয় মাত্রার তিনগুণ:
ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের মাত্রা ও এর উৎস চিহ্নিতপূর্ব
দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও নিয়ন্ত্রণের বাহিরেই রয়ে যাচ্ছে ধুলিদূষণ। গবেষণার
ফলাফলে লক্ষ্য করা যায় যে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের ধুলি দূষণের (পিএম১০) মাত্রা অত্যধিক
(সর্বোচ্চ ৪৯৯ ইউজিএম/এম৩) যা পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ এর মানমাত্রা (সর্বোচ্চ
১৫০ ইউজিএম/এম৩) অপেক্ষা বেশি।
পৃথিবী
হয়ে উঠছে প্লাস্টিকের গ্রহ’:
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্লাস্টিকের অধিক উৎপাদন এবং খোলা
প্রকৃতিতে এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়া বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এভাবে
চলতে থাকলে পৃথিবী খুব দ্রুতই পরিণত হবে একটি প্লাস্টিকের গ্রহে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত
উৎপাদিত প্লাস্টিকের পরিমাণ ৮.৩ বিলিয়ন টন। আর তাদের হিসাবে ২০৫০ সাল নাগাদ প্লাস্টিকের
পরিমাণ দাঁড়াবে ১২ বিলিয়ন টন।
ই-বর্জ্য:
ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বাংলাদেশ:
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) বলছে যে, এশিয়ায়
বৈদ্যূতিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য এর সিংহভাগই যায় চীন, হংকং, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ
এবং ভিয়েতনামে। যেখানে রয়েছে, ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকি। সংস্থা বলছে, বিশ্বের বৈদ্যূতিক
বর্জ্যের নব্বুই শতাংশই বেআইনীভাবে কেনাবেচা হয় অথবা তা আর্বজনা হিসাবে স্তুপীকৃত হয়।
যার মূল্য প্রায় উনিশশো কোটি ডলার।
বাংলাদেশে
ইয়াবা পাচার বন্ধে কোন প্রকার সহযোগিতা নেই মিয়ানমারের:
ইয়াবা পাচার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে এবারও কোনো
অঙ্গীকার করেনি মিয়ানমার। বলা চলে দুই দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত
তৃতীয় বৈঠকের ফলাফলও শূন্য।
বৈঠকের প্রাপ্তি বা সফলতা কী- এমন প্রশ্নের জবাবে মাদক
নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসির) মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমাদের কথাগুলো
আমরা বলে এসেছি। তাছাড়া মিয়ানমার সরকারের একটি নিজস্ব কর্মপদ্ধতি আছে। আগের দুই বৈঠকেও
তারা কোনো অঙ্গীকার করেনি। স্বাক্ষর করেনি কোনো যৌথ ইশতেহারে। যদিও এবারের বৈঠকের ফলাফলও
একই।
দেশে
অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে:
বাংলাদেশে অসংক্রামক
রোগের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষত উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা
এখন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে খাদ্যাভাস পরিবর্তনের মাধ্যমে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি
ইচ্ছা করলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য সচেতনতার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার, অধিক
ফল, বেশি করে সবজি গ্রহণ ও মানুষের খাদ্যাভাস পরিবর্তন জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগন।